Sunday, August 5, 2012

নবীদের দেখানো পথে দাওয়াহ দেওয়া এবং ইবরাহীম (আঃ)-এর মিল্লাতের অনুসারী হওয়া


নবীদের দেখানো পথে দাওয়াহ দেওয়া এবং ইবরাহীম (আঃ)-এর মিল্লাতের অনুসারী হওয়া যা হলো- দাওয়াহকে প্রকাশ্য এবং সুপরিচিত করে তোলা এবং ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে আপোষহীন শত্রুতা

এটাই হচ্ছে এই দ্বীনের ভিত্তি এবং প্রত্যেক নবীরই কর্মপন্থা।

‘‘আমি তোমার পূর্বে এমন কোন রাসূল প্রেরণ করি নাই তাহার প্রতি এই ওহী ব্যতিত যে, আমি ছাড়া কোন ইলাহ নাই। সুতরাং আমারই ইবাদাত কর।’’[1]

‘‘আমি প্রত্যেক উম্মতের নিকট রাসূল প্রেরণ করেছিলাম এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহ্র ইবাদত করবে এবং তাগুতকে বর্জন করবে....।’’[2]

‘‘আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের জন্য সেই দ্বীন নির্ধারিত করেছেন, যা তিনি নূহকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, এবং যা আমি আপনার প্রতি ওহীর মাধ্যমে প্রেরণ করেছি, আর আমি ইব্রাহীম, মূসা এবং ঈসাকে নির্দেশ দিয়েছিলাম যে, এই দ্বীনকে কায়েম কর এবং এতে কোন বিভেদ সৃষ্টি করো না; মুশরেকদের নিকট সেই (তাওহীদ) বিষয়টি বড়ই কষ্টকর মনে হয়- যার প্রতি আপনি তাদেরকে আহবান করেন, আল্লাহ্ তা’আলা যাকে ইচ্ছা নিজের দিকে আকৃষ্ট করে নেন এবং যে আল্লাহ্র দিকে রুজু হয়, তাকে তিনি তাঁর দিকে চলার সামর্থ্য দান করেন।’’[3]

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ‘লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘এই পৃথিবীতে এবং আখিরাতে দুই স্থানেই আমি সব মানুষের মাঝে মরিয়ম ইবনে ঈসা (আঃ)-এর সবচেয়ে নিকটবর্তী। নবীরা সবাই পৈত্রিক সম্পর্কে ভাই; তাদের মা ভিন্ন, কিন্তু তাদের দ্বীন একটাই।’[4]

উপরে উল্লেখিত আয়াত ও হাদিস এবং এরকম আরও যেসব দলিল আছে তা থেকে প্রমাণিত হয় যে, যদিও বিভিন্ন নবীর শরীয়াহ শাখা প্রশাখার মাঝে পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু ভিত্তি তাওহীদ ও দ্বীন সর্বক্ষেত্রেই অভিন্ন ছিল।

তাছাড়া আমাদেরকে অর্থাৎ উম্মতে মুহাম্মদী-কে এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ‘লাইহি ওয়া সাল্লাম-কেও আল্লাহ্ আদেশ করেছেন, এই ভিত্তির (তাওহীদ, কুফর বিত তাগুত, মিথ্যা উপাস্য এবং তাদের অনুসারীদের প্রতি শত্রুতা, ইত্যাদি) ক্ষেত্রে মিল্লাতে ইব্রাহীমের অনুসরণ করতে এবং তার উদাহরণ অনুকরণ করতে এবং এই একই ভিত্তি দেয়া হয়েছিল সমস্ত নবীদেরকে।

‘‘এখন আমি তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ করলাম, তুমি একনিষ্ঠ ইব্রাহীমের (আঃ) দ্বীনের অনুসরণ কর; এবং সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না।’’[5]

‘‘.... তিনি দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোন কঠোরতা আরোপ করেন নাই; এটা তোমাদের পিতা ইব্রাহীম (আঃ)- এর মিল্লাত; তিনি পূর্বে তোমাদের নামকরণ করেছেন ‘মুসলিম’ এবং এই কিতাবেও, যাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আ‘লাইহি ওয়া সাল্লাম তোমাদের জন্যে সাক্ষী স্বরূপ হয় এবং তোমরা সাক্ষী স্বরূপ হও মানব জাতির জন্যে....।’’[6]

এসব আয়াত থেকে সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, ইব্রহীম (আঃ)-এর পদ্ধতি ছিল তাওহীদের প্রকাশ্য ঘোষণা এবং সেই সাথে কুফর বিত্ তাগুত ও মুশরিকদের প্রতি ‘বারাআ’ (অভ্যন্তরীণ ঘৃণা ও বাহ্যিক শত্রুতা)। এমনকি দুর্বল অবস্থাতেও তিনি এই একই নীতিতে চলেছেন। আসলে, তারাই দুর্বল যারা নিজেদের দুর্বল মনে করে, আর যারা সবর করে এবং আল্লাহ্র উপর তাওয়াক্কুল করে তাদের জন্য আল্লাহ্ই সাহায্যকারী। যেমনটি ইব্রাহীম (আঃ) বলেছেনঃ ‘হাসবুনাল্লাহি ওয়া নি’মাল ওয়াক্বীল’। এবং আল্লাহ্ও বলেছেন যে তিনি মু’মিনদের ওয়ালী। তাহলে তার চেয়ে বেশী শক্তিশালী কে হতে পারে যার ওয়ালী স্বয়ং আল্লাহ্? আর সে কি কখনো দুর্বল হতে পারে? অবশ্যই না!

অথচ তারপরও অনেককেই দেখা যায় ইব্রাহীম (আঃ)-এর এই পথ থেকে দূরে সরে যেতে। তারা অজুহাত হিসেবে ‘দাওয়ার সুবিধা’ বা ‘মুসলিমদের ক্ষতি থেকে বাঁচানো’ ইত্যাদি কথা বলে। অথচ এই মিল্লাত থেকে যারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তাদেরকে আল্লাহ্ বলছেনঃ 
‘‘এবং যে নিজেকে নির্বোধ করে তুলেছে সে ব্যতীত কে ইব্রাহীমের (আঃ) দ্বীন হতে বিমুখ হবে? এবং নিশ্চয়ই আমি তাকে এই পৃথিবীতে মনোনীত করেছিলাম, নিশ্চয়ই সে পরকালে সৎ কর্মশীলগণের অন্তর্ভুক্ত।’’[7]

যারা এরকম সস্তা অজুহাত দিয়ে সঠিক পথ থেকে সরে যায়, তারা আসলে আল্লাহ্র প্রেরিত ওহীর চেয়ে নিজের নাফ্সকেই বেশী গুরুত্ব দেয়। আর শয়তান তাদের কাছে তাদের কাজকে সুন্দর এবং যৌক্তিক হিসেবে তুলে ধরে যাতে তারা এর খারাপ দিকগুলো বুঝতে না পারে। এসব লোকেরা কি মনে করে যে দাওয়াহ দেয়ার পদ্ধতির ব্যাপারে তারা ইব্রাহীম (আঃ) এর চেয়ে বেশী জ্ঞান রাখে? অথচ আল্লাহ্ তো এদেরকে ডেকেছেন ‘অজ্ঞ’ আর ইব্রাহীম (আঃ)-কে ঘোষণা করেছেন ‘শ্রেষ্ঠ উদাহরণ’ হিসেবে। এবং আল্লাহ্ তা’আলা ইব্রাহীম (আঃ)-এর ব্যাপারে আরো বলেছেনঃ
‘‘আমি তো এর পূর্বে ইব্রাহীমকে (আঃ) সৎ পথের জ্ঞান দিয়েছিলাম এবং আমি তার সম্বন্ধে সম্যক অবগত।’’[8]

‘‘তোমাদের জন্য ইব্রাহীম ও তার অনুসারীদের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। যখন তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিল, ‘তোমাদের সঙ্গে এবং তোমরা আল্লাহ্র পরিবর্তে যাদের ‘ইবাদত কর তাদের সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদের মানি না। তোমাদের ও আমাদের মধ্যে সৃষ্টি হল শত্রুতা ও ঘৃণা চিরকালের জন্য; যদি না তোমরা এক আল্লাহ্র প্রতি ঈমান আনো।’’[9]

সুতরাং ইব্রাহীম (আঃ)-এর মিল্লাত হলো তাগুতকে প্রকাশ্য এবং নির্ভয়ে প্রত্যাখ্যান করা, মুশরিকদের এবং তারা যাদের ইবাদত করে তাদের সবার সাথে ’বারাআ’ ঘোষণা করা, এবং আল্লাহ্র শত্রুদের প্রতি অন্তরে ঘৃণা পোষণ করা এবং তাদের বিরুদ্ধে শত্রুতা প্রদর্শন করা এগুলোই হলো দ্বীনের ভিত্তি এবং প্রত্যেক নবীর কাছে এই একই বার্তাই পাওয়া যায়।

‘‘আমি প্রত্যেক উম্মতের নিকট রাসূল প্রেরণ করেছিলাম এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহ্র ইবাদত করবে এবং তাগুতকে বর্জন করবে....।’’[10]

এবং আল্লাহ্ তা’আলা আরও বলেনঃ ‘‘এই ঘোষণাকে সে স্থায়ী বাণীরূপে রেখে গেছে তার পরবর্তীদের জন্যে যাতে তারা প্রত্যাবর্তন করে।’’[11]

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে তাওহীদের এই ঘোষণা ইব্রাহীম (আঃ)-এর পরবর্তী নবীদের জন্যও স্থায়ী করা হয়েছে। 

অন্যান্য নবীরা যে তাদের দুর্বল অবস্থাতেও এই একই পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন তার অনেক উদাহরণ আছে। সবচেয়ে ভয়ংকর শত্রুদের মুখোমুখি হয়েও তাঁরা মুশরিক এবং তাদের উপাস্যদের বিরূদ্ধে ’বারা’ ঘোষণা করেছেন।

‘‘আর তুমি তাদেরকে নূহের ইতিবৃত্ত পড়ে শুনাও, যখন সে নিজের কওমকে বললো- হে আমার কওম! যদি তোমাদের কাছে দুর্বহ মনে হয় আমার অবস্থান এবং আল্লাহ্র আদেশাবলী নসীহত করা, তবে আমার তো আল্লাহ্র উপর ভরসা, সুতরাং তোমরা তোমাদের (কল্পিত) শরীকদেরকে সঙ্গে নিয়ে নিজেদের তদবীর মজবুত করে নাও, অতঃপর তোমাদের সেই তদবীর (গোপন ষড়যন্ত্র) যেন তোমাদের দুঃচিন্তার কারণ না হয়, তারপর আমার সাথে (যা করতে চাও) করে ফেলো, আর আমাকে মোটেই অবকাশ দিও না।’’[12]

‘‘আমাদের কথা তো এই যে, আমাদের উপাস্য দেবতাদের মধ্য হতে কেউ তোমাকে দুর্দশায় ফেলে দিয়েছে; সে বললোঃ আমি আল্লাহ্কে সাক্ষী করছি এবং তোমরাও সাক্ষ্য থেকো, আমি ঐসব বস্তুর প্রতি অসন্তুষ্ট যাদেরকে তোমরা শরীক সাব্যস্ত করছো তাকে ছাড়া, অনন্তর তোমরা সবাই মিলে আমার বিরূদ্ধে ষড়যন্ত্র চালাও, অতঃপর আমাকে সামান্য অবকাশও দিও না। আমি আল্লাহ্র উপর ভরসা করেছি, যিনি আমারও প্রতিপালক এবং তোমাদেরও প্রতিপালক, ভূ-পৃষ্ঠে যত বিচরণকারী রয়েছে সবারই ঝুঁটি তাঁর মুষ্টিতে আবদ্ধ; নিশ্চয় আমার প্রতিপালক সরল পথে অবস্থিত।’’[13]

এভাবে কোরআনের অনেক আয়াত থেকে আমরা দেখতে পাই যে, হিযরতের আগেও মহানবী সাল্লাল্লাহু আ‘লাইহি ওয়া সাল্লাম-কে আল্লাহ্ তা’আলা এই একই পথের নির্দেশ দিয়েছেন এবং তিনি আল্লাহ্র এই নির্দেশ মেনে সেই পথেই চলেছেন-যদিও মুসলিমরা তখন ছিল খুবই কম সংখ্যক।

‘‘[হে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আ‘লাইহি ওয়া সাল্লাম!] আপনি বলুন, হে কাফেরগণ! তোমরা যার ইবাদত করছো, আমি তার ইবাদত করি না এবং আমি যাঁর ইবাদত করি তোমরা তার ইবাদত করো না এবং তোমরা যার ইবাদত করছো, আমি তার ইবাদতকারী নই, এবং আমি যাঁর ইবাদত করছি, তোমরা তাঁর ইবাদতকারী নও। তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন এবং আমার জন্য আমারই দ্বীন।’’[14]

‘‘আবূ লাহাবের দুই হাত ধ্বংস হোক এবং সে নিজেও ধ্বংস হোক।’’[15]

‘‘তোমরা কি ভেবে দেখেছো ’লাত’ ও ’উয্যা’ সম্বন্ধে এবং তৃতীয় আরেকটি ’মানাত’ সম্বন্ধে?তবে কি পুত্র সন্তান তোমাদের জন্যে এবং কন্যা সন্তান আল্লাহ্র জন্যে? এই প্রকার বন্টন তো অসঙ্গত। এগুলো কতক নাম মাত্র যা তোমাদের পূর্বপুরুষরা ও তোমরা রেখেছো, যার সমর্থনে আল্লাহ্ কোন দলীল প্রেরণ করেননি। তারা তো অনুমান এবং নিজেদের প্রবৃত্তিরই অনুসরণ করে, অথচ তাদের নিকট তাদের প্রতিপালকের পথ-নির্দেশ এসেছে।’’[16]

‘‘তোমরা এবং আল্লাহ্্র পরিবর্তে যাদের ইবাদত কর সেগুলো তো জাহান্নামের ইন্ধন; তোমরা সবাই তাতে প্রবেশ করবে। যদি তারা উপাস্য হতো তবে তারা জাহান্নামে প্রবেশ করতো না; তাদের সবাই তাতে স্থায়ী হবে।’’[17]

‘‘কাফিররা যখন তোমাকে দেখে তখন তারা তোমাকে শুধু বিদ্রূপেই গ্রহণ করে; তারা বলেঃ এই কি সেই, যে তোমাদের দেবতাগুলির সমালোচনা করে? অথচ তারাই তো ’রহমান’ এর উল্লেখের বিরোধিতা করে।’’[18]

তাহলে বোঝা যাচ্ছে যে কুরাইশের কাফিরদের ধারণা ছিল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ‘লাইহি ওয়া সাল্লাম এমন এক মানুষ যে কিনা তাদের ইলাহদের ব্যাপারে খারাপ কথা বলে। সত্যিকার অর্থে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ‘লাইহি ওয়া সাল্লাম এই সব ইলাহদের স্বরূপ সবার সামনে তুলে ধরতেন, এদের উপাসনার বিরূদ্ধে কথা বলতেন এবং এদেরকে আলিহা হিসেবে গ্রহণ করা যে কত বড় বোকামী ও অজ্ঞতা তা সবার কাছে স্পষ্ট করে দিতেন। এভাবেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আ‘লাইহি ওয়া সাল্লাম সেই একই পথের অনুসরণ করেছেন যে পথে এক সময় ইব্রাহীম (আঃ) চলেছেন- যদিও মক্কায় তিনি ছিলেন দুর্বল। নবীদের দাওয়াহ ছিল এমন যে সবসময়ই কাফিররা এর বিরধিতা করতো-এর প্রমাণ পাওয়া যায় যখন কুরাইশরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আ‘লাইহি ওয়া সাল্লাম-কে অত্যাচার করতো, তাকে বিতাড়িত করতে চাইতো এবং এমনকি হত্যার চেষ্টাও করতো। সঠিক দাওয়াহর প্রকৃতিই এমন।

মুশরিক এবং মু’মিনের এই দ্বন্দ চিরকালই হয়ে আসছে, কারণ আল্লাহ্ তাঁর স্বীয় ইচ্ছায় হক্ব (ও এর অনুসারী) এবং বাতিল (ও এর অনুসারী) আলাদা করে দিয়েছেন। এবং এই দুইয়ের মাঝে সব সময়ই যুদ্ধ চলে আসছে। আর এর মাধ্যমেই আল্লাহ্ তা’আলা জাহান্নামীদের জড়ো করেন এবং মু’মিনদের মাঝে থেকে বেছে নেন শহীদদের।

‘‘আর এমনিভাবেই আমি প্রত্যেক নবীর জন্যে বহু শয়তানকে শত্রুরূপে সৃষ্টি করেছি, তাদের কতক শয়তান মানুষের মধ্যে এবং কতক শয়তান জ্বিনদের হতে হয়ে থাকে, এরা একে অন্যকে কতগুলো মনোমুগ্ধকর, ধোঁকাপূর্ণ ও প্রতারণাময় কথা দ্বারা প্ররোচিত করে থাকে, তোমার প্রতিপালকের ইচ্ছা হলে তারা এমন কাজ করতে পরতো না, সুতরাং তুমি তাদেরকে এবং তাদের মিথ্যা রচনাগুলোকে বর্জন করে চলবে।’’[19]

‘‘আর এইভাবেই আমি সৃষ্টি করেছি প্রত্যেক নবীর জন্যই অপরাধপরায়ণ লোকদের মধ্যে থেকে শত্রু; এবং পথপ্রদর্শক ও সাহায্যকারীরূপে আপনার রবই যথেষ্ট।’’[20]

কাফিররা সবসময়ই নবীদের নিয়ে ঠাট্টা করতো- ‘‘আফসোস বান্দাদের উপর! তাদের নিকট কখনও এমন কোন রাসূলই আসেননি, যাকে তারা বিদ্রুপ না করেছে।’’[21]

‘‘আর সেই কাফেররা নিজেদের রাসূলগণকে বললো, আমরা তোমাদেরকে আমাদের দেশ হতে বের করে দেবো, নতুবা তোমরা আমাদের দ্বীনে ফিরে আসো; তখন সেই রাসূলগণের প্রতি তাহাদের রব ওহী প্রেরণ করলেন যে, আমি সেই যালিমদেরকে অবশ্যই ধ্বংস করব।’’[22]

‘‘যারা ঈমান এনেছে, দ্বীনের জন্যে হিজরত করেছে, নিজেদের জানমাল দ্বারা আল্লাহ্র পথে জিহাদ করেছে, এবং যারা আশ্রয় দান ও সাহায্য করেছে, তারা পরস্পরের বন্ধু, আর যারা ঈমান এনেছে, কিন্তু হিজরত করেনি তারা হিজরত না করা পর্যন্ত তাদের অভিভাবকত্বের কোন দায়িত্ব তোমাদের নেই, আর তারা যদি দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের নিকট সাহায্যপ্রার্থী হয়, তবে তাদের সাহায্য করা তোমাদের কর্তব্য, কিন্তু তোমাদের ও যে জাতির মধ্যে চুক্তি রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে নয়, তোমরা যা করছো আল্লাহ্ তা খুব ভাল রূপেই প্রত্যক্ষ করেন।’’[23]

‘‘আর তার সম্প্রদায়ের দাম্ভিক ও অহংকারী প্রধানরা বলেছিল - হে শো’আইব (আঃ)! আমরা অবশ্যই তোমাকে ও তোমার সঙ্গী সাথী মু’মিনদেরকে আমাদের জনপদ হতে বহিষ্কার করব অথবা তোমরা আমাদের ধর্মাদর্শে ফিরে আসবে, তখন সে বললো - আমরা যদি তাতে রাযী না হই (তবুও কি জোর করে ফিরিয়ে নিবে)?’’[24]

কাফেররা যে নবী ও মু’মিনদের উপর অত্যাচার চালায়, তাদের হত্যা করে, এবং তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে থাকে - এটা আসলে নতুন কিছু নয়।

‘‘....এটা এই কারণে যে এরা ক্রমাগত আল্লাহ্র আয়াতকে অস্বীকার করতে থাকলো এবং আল্লাহ্র নবীদের অন্যায়ভাবে হত্যা করতে শুরু করলো, ....।’’[25]

‘‘....কিন্তু পরে যখন তোমাদের নিকট কোন রাসূল-তোমাদের প্রবৃত্তি যা ইচ্ছে করতো না, তা নিয়ে উপস্থিত হলো তখন তোমরা অহংকার করলে; অবশেষে একদলকে মিথ্যাবাদী বললে এবং একদলকে হত্যা করলে।’’[26]

‘‘তারা বললোঃ হে শুআ’ইব (আঃ)! তোমার বর্ণিত অনেক কথা আমাদের বুঝে আসে না, এবং আমরা নিজেদের মধ্যে তোমাকে দুর্বল দেখছি, আর যদি তোমার স্বজনবর্গের লক্ষ্য না হতো, তবে আমরা তোমাকে প্রস্তারাঘাতে চূর্ণ করে ফেলতাম, আর আমাদের নিকট তোমার কোনই মর্যাদা নেই।’’[27]

‘‘তারা বললোঃ তোমরা সকলে পরস্পর শপথ করো যে, আমরা রাত্রিকালে ছালেহ্ (আঃ)-কে এবং তাঁর অনুসারীদেরকে হত্যা করে ফেলবো, অতঃপর আমরা তাঁর উত্তরাধিকারীদেরক�� � বলবো, আমরা তাদের হত্যাকান্ডে উপস্থিত ছিলাম না এবং আমরা সম্পূর্ণ সত্যবাদী।’’[28]

‘‘যদি তারা কোনরূপে তোমাদের সন্ধান জেনে ফেলে, তবে হয় তোমাদেরকে প্রস্তারাঘাতে মেরে ফেলবে অথবা তোমাদেরকে তাদের ধর্মে ফিরিয়ে নেবে এবং এরূপ ঘটলে কখনোই তোমরা সাফল্য লাভ করবে না।’’[29]

‘‘জনপদবাসীরা বললো, আমরা তো তোমাদেরকে অশুভ মনে করি, যদি তোমরা নিবৃত্ত না হও, তবে আমরা তোমাদেরকে প্রস্তারাঘাত করে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিবো এবং আমাদের পক্ষ থেকে কঠিন উৎপীড়ন তোমাদেরকে স্পর্শ করবে।’’[30]

এগুলো (শত্রুতা, বিদ্রুপ, হুমকি, অত্যাচার, হত্যা, দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়া ইত্যাদি) কোন কিছুই হতো না, যদি না নবীরা এবং তাদের অনুসারী মু’মিনরা তাগুতকে উম্মোচিত না করতেন, যদি না তারা শির্ক এবং মুশরিকদের থেকে ‘বারা’ ঘোষণা না করতেন। সুতরাং প্রিয় ভাই ও বোনেরা, এটা আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে যাওয়া উচিত যে, এই পথে চললে আমাদেরও এ সবের মুখোমুখি হতে হবে। আর এই পথই নবীদের পথ, এই পথই মিল্লাতে ইব্রাহীম (আঃ)-এর দেখানো পথ। এই সেই পথ যেই পথে তাওহীদের ডাক সবদিকে ছড়িয়ে যায়। যেমন হয়েছিল সূরা বুরুজে বর্ণিত মু’মিনদের ক্ষেত্রে।

[1] সূরা আম্বিয় া ২১ঃ ২৫

[2] সূরা নাহ্ল ১৬ঃ ৩৬

[3] সূরা শূরা ৪২ঃ ১৩

[4] বুখারী

[5] সূরা নাহ্ল ১৬ঃ ১২৩

[6] সূরা হাজ্জ ২২ঃ ৭৮

[7] সূরা বাকার ২ঃ ১৩০

[8] সূরা আম্বিয়া ২১ঃ ৫১

[9] সূরা মুমতাহিনা ৬০ঃ ৪

[10] সূরা নাহ্ল ১৬ঃ ৩৬

[11] সূরা যুখরুফ ৪৩ঃ ২৮

[12] সূরা ইউনুস ১০ঃ ৭১

[13] সূরা হূদ ১১ঃ ৫৪-৫৬

[14] সূরা কাফিরূন ১০৯ঃ ১-৬

[15] সূরা লাহাব ১১১ঃ ১

[16] সূরা নাজ্ম ৫৩ঃ ১৯-২৩

[17] সূরা আম্বিয়া ২১ঃ ৯৮-৯৯

[18] সূরা আম্বিয়া ২১ঃ ৩৬

[19] সূরা আন’আম ৬ঃ ১১২

[20] সূরা ফুরকান ২৫ঃ ৩১

[21] সূরা ইয়াসীন ৩৬ঃ ৩০

[22] সূরা ইবরাহীম ১৪ঃ ১৩

[23] সূরা আনফাল ৬ঃ ৭২

[24] সূরা আ‘রাফ ৭ঃ ৮৮

[25] সূরা বাকারা ২ঃ ৬১

[26] সূরা বাকারা ২ঃ ৮৭

[27] সূরা হূদ ১১ঃ ৯১

[28] সূরা নামল ২৭ঃ ৪৯

[29] সূরা কাহ্ফ ১৮ঃ ২০

[30] সূরা ইয়াসীন ৩৬ঃ ১৮

যে সব বিষয় ‘‘শাহাদাহ’’ (লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহ) অকার্যকর করে

[যে সকল কাজ বা আমল একজন মুসলিমকে কাফেরে পরিণত করে]

মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়। আবার মুসলমান হবার পর কুফরী করলে সে কাফির হয়ে যায়। যে ব্যক্তি তার দীন ও ঈমানকে প্রত্যাহার করে কাফির হয় শরীয়তের পরিভাষায় তাকেই মুরতাদ বলা হয়। চাই সে ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলুক, কুফরীর আনুগত্য বা অনুসরণ করুক বা নামায পড়ুক আর না পড়ুক। আমাদের একটি ভুল ধারণা রয়েছে যে কেউ মুসলিম পরিবারের জন্ম গ্রহণের ফলেই ঈমান তার ওপর জেঁকে বসে। অতএব, ঈমান কার ওপর আনতে হবে, কিভাবে ঈমানকে রক্ষা করতে হবে - এগুলোর জানার কোনই প্রয়োজন নেই। অথচ সমস্ত কুফরকে প্রত্যাখ্যান করে ইসলামী বিধান যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমেই ঈমানের ওপর টিকে থাকা এবং নিজেকে সত্যিকার মুসলমান হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। 

একজন মুসলমান হিসেবে আমাদের খুঁজে বের করা প্রয়োজন যে সকল কুফরীর কারণে মুসলমান কাফের হয় অর্থাৎ ইসলামের গন্ডি থেকে বের হয়ে যায় এগুলো নিম্নে দশটি দফায় সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলোঃ

একঃ আস-শিরকঃ আল্লাহ্র (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) ইবাদতে শরীক করা, এ ব্যাপারে মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ্ বলেছেনঃ
‘‘আল্লাহ কেবল শিরকের গুনাহই মাফ করেন না; উহা ব্যতিত আর যত গুনাহ আছে তা যার জন্য ইচ্ছা মাফ করে দেন। যে লোক আল্লাহ্র সাথে অন্য কাউকেও শরীক করল; সে তো বড় মিথ্যা রচনা করল, এবং বড় কঠিন গুনাহের কাজ করল।’’ (সূরা আন-নিসা ৪, আয়াত ৪৮)

এবং মহাপরাক্রমশালী আরো বলেনঃ
‘‘... বস্ত্তত আল্লাহ্র সাথে অন্য কাউকেও যে শরীক করেছে আল্লাহ্ তার ওপর জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন। আর তার পরিণতি হবে জাহান্নাম। এ সব জালেমের কোনই সাহায্যকারী নেই।’’ (সূরা আল-মায়িদাহ ৫, আয়াত ৭২)

কেউ আল্লাহ্র সাথে যে বিভিন্ন প্রকার শরীক করতে পারে তার মধ্যে রয়েছে ইতিপূর্বে বর্ণিত অলিহাহ, আরবাব, আনদাদ ও তাগুত।

বর্তমান কালের কয়েকটি বড় বড় শিরক সমূহের মধ্যে রয়েছে মাজার ও কবর পুজা, পীর ও অলি আল্লাহ গায়েব জানেন। অসুস্থকে সুস্থ করতে পারেন। বাচ্চা দিতে পারেন, বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারেন কিংবা আমাদের মনের খবর পীর বাবার জানা ইত্যাদি ধারণা পোষণ করা সুস্পষ্ট শিরক। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা একমাত্র আইন ও বিধান দাতা। কুরআন আর সুন্নাহর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন সমাজ, রাষ্ট্র, শিক্ষা, বিচার ব্যবস্থা, শাস্তি, অর্থনীতি কিভাবে চালাতে হবে এবং এগুলির ব্যাপারে আল্লাহর দেয়া বিধানই প্রত্যেক মুসলিমের একমাত্র সংবিধান। যদি কেউ আল্লাহর দেয়া সংবিধানের উপর নিজেরা আইন তৈরি করে তবে তারা তাগুত (আল্লাহদ্রোহী, সীমালংঘনকারী) এ পরিণত হবে। যারা তাগুতের তৈরি সংবিধানকে মানবে তারা আইন মানার বিষয়ে আল্লাহর সাথে শিরক করে মুশরিকে পরিণত হবে। এমনিভাবে আল্লাহর দেয়া শরীয়া আইন বাদ দিয়ে যে সমস্ত বিচারক মানুষের তৈরী করা আইন দিয়ে বিচার ফায়সালা করে তারাও তাগুত। এবং যে সকল লোক তাদের কাছে নিজের ইচ্ছায় বিচার-ফায়সালা নিয়ে যাবে তারাও শিরকের গুনাহতে লিপ্ত হয়ে ইসলাম থেকে বাদ পড়ে যাবে।


দুইঃ যে ব্যক্তি তার নিজের এবং আল্লাহ্র (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) মধ্যে মধ্যস্থতা ও যোগাযোগের মাধ্যম বানায় এবং তাদের কাছে তার মনোস্কামনা পূরণের (শাফায়া) জন্য আবেদন-নিবেদন করে এবং তাদের ওপর নির্ভর করে (তাওয়াক্কুল) সে কাফির (অবিশ্বাসী) হয়ে যায়। এটাই অতীত ও বর্তমানকালের মুসলমানদের সর্বসম্মতি (ইজমা)।

‘‘তারা আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে এমন বস্ত্তর উপাসনা করে, যা তাদের না করতে পারে কোনো ক্ষতি, না করতে পারে কোনো উপকার। আর তারা বলে, এরা তো আল্লাহ্র কাছে আমাদের সুপারিশকারী। আপনি বলে দিন, তোমরা কি আল্লাহ্কে এমন বিষয়ে অবহিত করতে চাও, যে সম্পর্কে তিনি আসমান ও জমীনের মাঝে অবহিত নন? তিনি পুতঃপবিত্র ও মহান সে সমস্ত জিনিস থেকে, যে গুলোকে তোমরা শরীক করছো।’’ (সূরা ইউনুছ ১০ঃ আয়াত ১৮) 
‘‘জেনে রাখো, নিষ্ঠাপূর্ণ ইবাদত আল্লাহ্রই নিমিত্ত। যারা আল্লাহ্ ব্যতীত অন্যকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করে এবং বলে যে, আমরা তাদের ইবাদত এজন্যই করি যেনো তারা আমাদেরকে আল্লাহ্র নিকটবর্তী করে দেয়। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তাদের মধ্যে তাদের পারষ্পরিক বিরোধপূর্ণ বিষয়ের ফয়সালা করে দিবেন। আল্লাহ্ মিথ্যাবাদী কাফেরকে সৎপথে পরিচালিত করেন না।’’ (সূরা আয্-যুমার ৩৯, আয়াত ৩ ) 
এর একটি স্পষ্ট উদাহরণ হবে যদি কোন ব্যক্তি একজন পীর (ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব) বা দরবেশের কাছে যায় এবং তাদেরকে সন্তান দেয়ার জন্য দোয়া করার অনুরোধ জানায়, এছাড়াও তাবীজ দিতে বলে আর বিশ্বাস স্থাপন করে পীরবাবার তাবীজে সে সুস্থ হবে অথবা মন কামনা পূর্ণ হবে এসকল কাজ দ্বারা আল্লাহ্ তায়ালা রুবুবিয়াতের সাথে পীরবাবা বা বুজুর্গকে শরীক করা হয় এটা সুষ্পষ্ট শিরক যা কিনা একজন মুসলমানকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়।


তিনঃ যে ব্যক্তি বহুইশ্বরবাদীকে (মুশরিক) প্রত্যাখ্যান অথবা তাদের ধারণায় সন্দেহ করে না সে কাফির হয়ে যায়। উদাহরণ স্বরূপ যদি কোন লোক বলে যে, সে নিশ্চিত নয় একজন খৃষ্টান কাফির কি না, তাহলে সে নিজেই একজন কাফির হয়ে যায় কারণ সে ঈসাকে (আঃ) খোদা হিসেবে গ্রহণকারী খৃষ্টানদের (মুশরিক, পৌত্তলিক) প্রত্যাখ্যান করেনি।


চারঃ যে ব্যক্তি মহানবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর পরিপূর্ণতা ও দিক নির্দেশনা বা ফায়সালায় অবিশ্বাস করে সে কাফির। এর কারণ হচ্ছে আল্লাহ্র রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তার ফায়সালা হচ্ছে সীরাতুল মুসতাকিমের উপর। আর যারা তাগুতের কাছে যাওয়া বেশী পছন্দ করে তারা সত্য সঠিক পথ হতে বহু দূরে। 
‘‘যে লোকের কাছে আল্লাহ্র হেদায়াত পরিষ্কারভাবে প্রকাশ পাবার পরও সে রাসূলের বিরোধীতা করে এবং মু’মিনদের পথ ব্যতীত অন্য কারুর পথের অনুসরণ করে, তাকে সেই দিকেই আমি ফিরিয়ে দেব যে দিক সে ফিরে যেতে চায়। আর আমি তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাব, এ জাহান্নাম অত্যন্ত খারাপ আবাস। আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর অংশীদারকারীকে যে ক্ষমা করবেন না তা নিশ্চিত কথা। তবে এ ছাড়া অন্যান্য গুনাহ যাকে ইচ্ছে তিনি ক্ষমা করবেন। যারা আল্লাহ্র সাথে কোন কিছু শরীক করে তারা চরমভাবে ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত।’’ (সূরা নিসা ৪, আয়াত ১১৫-১১৬)

এ আয়াত দ্বারা পরিস্কার রূপে প্রমাণিত হয় যে রাসূলের প্রদর্শিত পথের বিরোধিতা করা এবং মু’মিনদের পথ ছেড়ে অন্য কোন পথ গ্রহণ করা শিরক। এর শাস্তি হচ্ছে সবচেয়ে নিকৃষ্টতম স্থান জাহান্নামে বন্দি করে রাখা। এ বিষয়ের ওপর এদিক দিয়ে আলোচনা হতে পারে যে এটা আল্লাহ্ তায়ালা এবং তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে প্রমাণিত কি না? যদি আল্লাহ্ তায়ালা ও তাঁর রাসূলের কথা নির্ধারিত হয়, তাহলে তা নিয়ে কানাঘুষা করা এবং হেকমতের পরিপন্থী আখ্যা দেয়া, একে যুগের পরিপন্থী বলা এবং তা ছেড়ে নিজের মনগড়া পথের বা অন্য কারুর অন্ধ অনুকরণে অন্য পথের আশ্রয় নেয়া সুষ্পষ্ট শিরক। আল্লাহ্ শিরককে কখনোই ক্ষমা করবেন না। 

পাঁচঃ যে ব্যক্তি নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যাকিছু নিয়ে এসেছেন তাতে অসন্তুষ্ট যদিও সে এ অনুযায়ী কাজ করে, সে অবিশ্বাসী (কাফির) হয়ে গেছে। এরকম এক উদাহরণ হতে পারে এমন এক ব্যক্তি যে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে অথচ সে এগুলো করা অপছন্দ করে অথবা এমন এক মহিলা যে হিজাব পরে অথচ সে তা পরা অপছন্দ করে।

‘‘আর মানুষের মধ্যে এমন কিছু লোক রয়েছে যারা বলে আমরা আল্লাহ্ ও পরকালের প্রতি ঈমান এনেছি, অথচ প্রকৃতপক্ষে তারা ঈমানদার নয়।’’ (সূরা আল বাক্বারাহ ২, আয়াত ৮)

‘‘না, হে মুহাম্মদ, তোমার রবের নামে কসম, তারা কিছুতেই ঈমানদার হতে পারে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ন্যায়বিচারক হিসেবে মেনে নিবে। অতঃপর তুমি যাই ফয়সালা করবে সে ব্যাপারে তারা নিজেদের মনে বিন্দুমাত্র কুন্ঠাবোধ করবেনা বরং ফয়সালার সামনে নিজেদেরকে সম্পূর্ণরূপে সমর্পন করবে।’’ (সূরা আন-নিসা ৪ঃ আয়াত ৬৫)


ছয়ঃ যে ব্যক্তি দ্বীনের (ধর্মের) আওতার কোনকিছুর ব্যাপারে উপহাস করে বা কৌতুক করে অথবা ইসলামের কোন পুরস্কার বা শাস্তির ব্যাপারে ব্যাঙ্গ করে সে কাফির হয়ে যায়। এর প্রমাণ হচ্ছে আল্লাহ্র (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) এই কথাঃ
‘‘বল, তোমাদের হাসি-তামাসা ও মন-মাতানো কথাবার্তা কি আল্লাহ্, তাঁর আয়াত এবং তাঁর রসূলের ব্যাপারেই ছিল? এখন টাল-বাহানা করিও না। তোমরা ঈমান গ্রহণের পর কুফরী করেছ ...’’ (সূরা আত-তওবাহ ৯, আয়াত ৬৫-৬৬)


সাতঃ জাদু (আস-সিহর)। সকল প্রকার জাদু নিষিদ্ধ কেউ এতে অংশগ্রহণ করুক, সময় ব্যয় করুক বা চর্চার প্রতি সহানুভূতিশীল হোক না কেন। যে ব্যক্তি জাদু চর্চা করে বা জাদুতে খুশী হয়, সে কাফির হয়ে যায়। কারণ আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) পবিত্র কুরআনে বলেছেনঃ
‘‘... প্রকৃতপক্ষে সোলাইমান কখনই কুফরী অবলম্বন করে নাই। কুফরী অবলম্বন করেছে সেই শয়তানগণ যারা লোকদেরকে যাদুগিরি শিক্ষাদান করতেছিল।’’ (সূরা আল বাকারা ২, আয়াত ১০২)


আটঃ যে ব্যক্তি একজন মুশরিককে (বহু ইশ্বরবাদী, কাফের) সাহায্য ও সমর্থন করে এবং মুসলমানের বিরুদ্ধে তাকে সহায়তা করে সে কাফির কারণ তার কাছে আল্লাহ্র (সুবহানু ওয়া তায়ালা) প্রতি বিশ্বাস রাখে এমন একজন মুসলমানের তুলনায় আল্লাহ্র (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) শত্রু বেশী প্রিয়। এর প্রমাণ হচ্ছে আল্লাহ্র (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) এই কথাঃ 
‘‘হে ঈমানদার লোকেরা, নিজেদের পিতা ও ভাইকেও বন্ধু (সমর্থক ও সাহায্যকারী) হিসেবে গ্রহন করিও না যদি তারা ঈমান অপেক্ষা কুফরকে অধিক ভালবাসে। তোমাদের যে লোকই এই ধরনের লোকদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে সে-ই যালেম (অন্যায়কারী) হবে।’’ (সূরা আত-তওবাহ ৯, আয়াত ২৩)

‘‘তোমাদের মধ্যে কেউ যদি তাদেরকে [মুশরিকদেরকে] বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তাহলে সে তাদের মধ্যেই গণ্য হবে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ তায়ালা জালেমদেরকে হেদায়াত করেন না।’’(সূরা মায়িদাহ ৫, আয়াত ৫১)


নয়ঃ যদি কোন ব্যক্তি বিশ্বাস করে যে, সে শারিয়াহ এর মধ্যে (আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার আইন) বিভিন্ন জিনিস যোগ করা অথবা এর কতিপয় বিষয় বাদ দেওয়ার মাধ্যমে ইসলামের উন্নতি সাধন করতে পারবে তাহলে সে কাফির হয়ে যায়।

এর কারণ হচ্ছে আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) পরিপূর্ণভাবে সকল মানুষের জন্য তার নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে ইসলামের বাণী পাঠিয়েছেন এবং যদি কেউ এটা অস্বীকার করে তাহলে সে কুরআনের এই আয়াতের বিরুদ্ধে যায়ঃ
‘‘আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে তোমাদের জন্য সম্পূর্ণ করে দিয়েছি এবং আমার নিয়ামত তোমাদের প্রতি পূর্ণ করেছি আর তোমাদের জন্য ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে কবুল করে নিয়েছি।’’ (সূরা আল-মায়িদাহ ৫, আয়াত ৩)


দশঃ মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর প্রতি অবতীর্ণ বাণী শিক্ষা না করা অথবা সে অনুযায়ী কাজ না করার মাধ্যমে কেউ আল্লাহ্র (সুবহানু ওয়া তায়ালার) বাণীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে সে ইসলামের গন্ডির বাইরে চলে যায়। আল-কুরআনে এর প্রমাণ হচ্ছেঃ
‘‘তার চাইতে বড় যালেম আর কে হবে যাকে তার আল্লাহ্র আয়াতের সাহায্যে উপদেশ দান করা হয় এবং তা সত্ত্বেও সে তা হতে মুখ ফিরিয়ে থাকে? এসব পাপীদের ওপর তো আমরা প্রতিশোধ নিয়েই ছাড়ব।’’ (সূরা আস-সাজদাহ ৩২, আয়াত ২২)


এগুলোই দশটি বিষয় যা কোন ব্যক্তির ইসলামকে অকার্যকর করতে পারে এবং যদি সে তার ভুলের জন্য আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) এর কাছে অনুতপ্ত না হয় এবং সে মৃত্যু বরণ করার আগে আবার ইসলাম গ্রহণ না করে তাহলে একজন মুশরিক (পৌত্তলিক) বা একজন কাফিরের (অবিশ্বাসী) মৃত্যুবরণ করে, আর তার গন্তব্যস্থল হয় অনন্ত কালের জন্য দোজখের আগুন এবং কোনদিনও জাহান্নামের আগুন থেকে বের করা হবে না।


শাহাদাহ বা ‘লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহ’-এর সাতটি শর্ত

শাহাদাহ বা ‘লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহ’-এর সাতটি শর্ত

নামাযের মত তাওহীদেরও অনেকগুলো শর্ত আছে। নামায সহীহ হওয়ার শর্তাবলীর মধ্যে যদি যে কোনো একটি শর্ত যেমন অজু করা বা কেবলামুখী হওয়া ইত্যাদি না পাওয়া যায় তাহলে নামায বাতিল বলে গণ্য হবে। তেমনি শাহাদাহ্ সাতটি শর্ত সম্বলিত, যা পরিপূর্ণভাবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়োগের পর আমাদের মাঝে ইসলামের প্রথম স্তম্ভ (ঈমান) স্থাপিত হওয়ার দাবী করতে পারব। এ সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা এবং এর শর্তগুলো পূরণ করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ওয়াযিব। আবদুল্লাহ্ ইবনে আববাস (রাঃ) কে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিলেনঃ- ইহা কি সত্য যে, লা ইলাহা ইল্লাহ এবং মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাক্ষ্যদানই বেহেস্তে প্রবেশের চাবিকাঠি? তিনি বললেন হ্যাঁ ঠিক। তবে প্রত্যেক চাবিতেই কিছু দাঁত থাকে এবং দাঁত ব্যতীত কাংখিত দরজাটি খোলা সম্ভব নয়। অনুরূপভাবে কালেমারও সাতটি দাঁত রয়েছে এবং আমাদের জীবনে এর যে কোন একটির অভাব ঈমানের দাবীকে পরিপূর্ণ করে না এবং এর ফলে শাহাদাহ অকার্যকর (বাতিল) হয়ে পড়ে।


প্রথম শর্তঃ ইল্ম বা জ্ঞান


আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, فاعلم انه لا اله الا الله-


‘‘তুমি জেনে রাখো, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ্ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই)।’’ (মুহাম্মদঃ১৯)


[তাওহীদের] এলেম বা জ্ঞানকে বান্দার ইসলাম কবুলের প্রথম শর্ত নিধারণ করা হয়েছে।


কালেমার শব্দসমূহের জ্ঞান অর্জনঃ কালেমা দু’টি অর্থপূর্ণ বাক্যের সমষ্ঠি- আল্লাহ্ ব্যতীত ইবাদতের যোগ্য কোন ইলাহ্ (রব) নেই। এবং হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহ্ প্রেরিত সর্বশেষ নবী ও রাসূল। কালেমার প্রথম অংশকে ‘‘তাওহীদ’’ ও দ্বিতীয় অংশকে ‘‘রিসালাত’’ বলা হয় উভয় অংশে বিশ্বাস রাখা অপরিহার্য।


তাওহীদের নিন্মোক্ত বিষয়সমূহ জানতে ও মানতে হবে


(১) আল্লাহ্ই একমাত্র রব। তিনিই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা, একমাত্র অনন্তকাল থাকবেন। তিনি একমাত্র অদৃশ্য ও ভবিষ্যতের ব্যাপারে জ্ঞান রাখেন (আলেমুল গায়েব)। তিনিই একমাত্র রিযিকদাতা ও নিরাপত্তাদানকারী�� � তিনিই জীবন-মৃত্যুর মালিক। তিনিই মাতৃগর্ভে শিশুর প্রকৃতি সম্পর্কে অবহিত। তিনিই জানেন কখন বৃষ্টি হবে। তিনিই জানেন মানুষ আগামীকাল কি উপার্জন করবে। তিনিই সবার মৃত্যুর সময় ও স্থান নির্ধারণকারী। আল্লাহ্র এই গুণাগুণসমূহ সামগ্রিকভাবে ‘তাওহীদ আল-রুবুবিয়াহ্র’ অন্তর্গত।


যদি কেউ এই ধারনা পোষণ করে যে আমেরিকা বা জাতিসংঘ (ইউ, এন) তার নিরাপত্তা বিধান করবে অথবা তার ব্যবসা বা তার মনিব বা সরকার তাকে রিযিক দিবে, জ্যোতিষ বা ভাগ্যগণনাকারী তার ভবিষ্যত বলে দিবে; তাহলে সে ‘‘তাওহীদ আল-রুবুবিয়াহ্কে’ অস্বীকার করল।


(২) একমাত্র আল্লাহ্ সুবহানাহু তা’য়ালা ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত করা (হুকুমের অনুসরণ) যাবে না। সকল ইবাদত (যেমন- নামায, রোযা, কোরবানী বা ত্যাগ) কেবলমাত্র আল্লাহ্রই প্রাপ্য।


যদি কেউ কোন পূর্ণ্যবান মৃত ব্যক্তি বা কবরের (মাজার) কাছে অথবা কোন ধর্মীয় নেতার (পীর, ফকির) কাছে তার মনের আকাঙ্খা পুরণের জন্য প্রার্থনা করে এবং তাদের নিকট সওয়াবের উদ্দেশ্যে দান করে তবে সে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ অস্বীকার করলো। যা একটি প্রকাশ্য কুফুরী এবং ‘তাওহীদ আল উলুহিয়ার’ পরিপন্থী।


(৩) আমরা জানি যে, আল্লাহ্র নিরানববইটি সুন্দর নাম রয়েছে যার প্রত্যেকটি পৃথক পৃথকভাবে আল্লাহ্্র গুণ-সমূহকে প্রকাশ করে। এই গুণবাচক নামসমূহের প্রত্যেকটির উপর ঈমান আনা ফরয। এই নামসমূহের উপর বিশ্বাস স্থাপনই ‘তাওহীদ আল-আসমাআল সিফাত’।


(৪) আল্লাহই একমাত্র আইনদাতা এবং এই বিশ্বজগতে আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কেউ আইন প্রণয়ণের অধিকার রাখে না। অন্য কথায়, ব্যক্তিজীবন, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও পৃথিবী একমাত্র কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে পরিচালিত হতে হবে। যদি আমরা মনে করি যে, আল্লাহ্র আইন (শরীয়াহ) যা রাসূল (সাঃ) ও খিলাফায়ে রাশেদার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা সেকেলে, অপ্রয়োজনীয়, নিকৃষ্ট এবং আল্লাহ্র আইনের (শরীয়াহ) তুলনায় ব্রিটিশ বা আমেরিকান আইন বা অন্য যে কোন মতাদর্শ বা জীবনব্যবস্থা (যেমন-গণতন্ত্র, রাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, পুঁজিবাদ, ধর্মনিরপেক্ষবাদ ইত্যাদি) এগুলির যে কোনটি যদি বর্তমান প্রেক্ষাপটে অধিকতর গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় তাহলে এই ধারণা পোষণকারী ব্যক্তির লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ঘোষণা কার্যকর হবে না। এই ধারণাই কুফরী এবং ‘তাওহীদ আল হাকিমিয়াহর’’ প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন।


প্রত্যেককেই রিসালাত সংক্রান্ত নিন্মোক্ত বিষয়সমূহ মানতে হবেঃ


(১) আমাদেরকে অবশ্যই মানতে হবে যে, মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ (সাঃ) আল্লাহ্ পাক প্রেরিত সর্বশেষ নবী ও রাসূল এবং তাঁর প্রতি সর্বশেষ আসমানী কিতাব কুরআন নাযিল করা হয়েছে। 


(২) সাইয়্যেদুল মুরসালীন রাসূল (সাঃ) এর প্রত্যেকটি কথা, কাজ ও মৌনসম্মতিকে সুন্নাহ বলে যা আল্লাহ্ রাববুল আলামিন কর্তৃক অনুমোদিত।


‘‘সে [মুহাম্মদ (সাঃ)] মনের ইচ্ছায় বলে না। কোরআন অহী, যা প্রত্যাদেশ হয়।’’ (আন-নাজ্মঃ ৩-৪)


সুতরাং প্রত্যেক মুসলমানকে রাসূল (সাঃ)-এর সুন্নত অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে। 


(৩) আমাদেরকে এই বিষয়টি মানতে হবে যে, আল্লাহ্র রাসূল (সাঃ) বিশ্বজগতের সর্বোৎকৃষ্ট গুণাবলী সম্পন্ন এবং সর্বশ্রেষ্ঠ মানব।


(৪) আমাদেরকে অবশ্যই রাসূল (সাঃ)-কে সবকিছু (ব্যক্তি ও বস্ত্ত) অপেক্ষা বেশি ভালবাসতে হবে। আল্লাহ্র রাসূল (সাঃ) বলেছেন,-তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মু’মিন হতে পারবে না যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান এবং সমগ্র মানবকুল অপেক্ষা আমাকে বেশী ভাল না বাসবে। [সহীহ্ আল বুখারী/সহীহ্ মুসলিম]


দ্বিতীয় শর্তঃ (আল-ইয়াক্বীন) নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস স্থাপন


আমাদেরকে অবশ্যই শাহাদার প্রথম শর্তের [তাওহীদ ও রিসালাত] উপর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে হবে। আল্লাহ্র অস্তিত্ব, আল্লাহ্র রাসূল (সাঃ), ফেরেস্তা, আসমানী কিতাবসমূহ, বিচার দিবস, তাক্দীর, জান্নাত, জাহান্নাম ইত্যাদির ব্যাপারেও কোনরূপ সন্দেহ পোষণ করার অবকাশ নেই। আল্লাহ্ সুবহানাহু তায়া’লা ও রাসূল (সাঃ)-এর বক্তব্যের বিরুদ্ধাচারণ করা যাবে না।


‘যে আল্লাহ্ ফেরেশ্তা, কিতাবসমূহ, রাসূলগণ ও পরকালকে অবিশ্বাস করে সে মারাত্মকভাবে পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে।’ ( নিসাঃ ১৩৬)


আমাদেরকে আবু বকর (রাঃ)-এর ন্যায় ঈমান আনতে হবে যেরূপ তিনি ‘ইস্রা’ ও ‘মিরাজের’ ব্যাপারে ঈমান এনেছিলেন। একদা আবু জেহেল তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিল যে কেউ যদি তোমাকে এরূপ বলে যে, সে একরাতে মাসজিদুল আকসা, সাত আসমান, বেহেস্ত, দোযখ পরিভ্রমণ শেষে আবার ঐ রাতেই মক্কায় ফিরে এসেছে তবে তুমি কি তার কথা বিশ্বাস করবে? আবু বকর (রাঃ) জবাব দিলেন অবশ্যই নয়। তখন আবু জেহেল বলল যদি তোমার বন্ধু মুহাম্মদ (সাঃ) এইরূপ কথা বলে? এর জবাবে আবু বকর (রাঃ) বললেন যদি আল্লাহ্র রাসূল (সাঃ) এইরূপ কথা বলে থাকেন তবে ইহা অবশ্যই সত্য এবং নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করি। এই ঘটনার পর আল্লাহ্র রাসূল (সাঃ) তাকে আল-সিদ্দিক (বিশ্বাসী) উপাধিতে ভুষিত করেন। আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) ছিলেন সন্দেহের বেড়াজাল থেকে মুক্ত এবং এভাবেই আমাদের দ্বিতীয় শর্ত পূরণ করতে হলে এরূপ বিশ্বাসী হতে হবে।


‘‘প্রকৃতপক্ষে মু’মিন তো তারাই যারা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছে, অতঃপর কোন সন্দেহ করে না এবং নিজেদের জীবন ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহ্র পথে জিহাদ করে। শুধুমাত্র তারাই (ঈমানের দাবীতে) সত্যবাদী।’’ ( আল-হুজরাতঃ ১৫)


তৃতীয় শর্তঃ (আল-কবুল) প্রকাশ্যে এবং গোপনে ঈমানের স্বীকৃতি


আমাদের অবশ্যই তাওহীদ ও রিসালাতের (শর্ত ০১) ব্যাপারে অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে এবং যে কোন প্রেক্ষাপটের মোকাবেলায় মৌখিক স্বীকৃতি দান ও বাহ্যিকভাবে মেনে নিতে হবে। কেবলমাত্র অন্তরে বিশ্বাস স্থাপনই যে যথেষ্ট নয় এবং মৌখিক ও বাহ্যিক স্বীকৃতিও প্রয়োজনীয়তা আবশ্যক তা আবু তালেবের জীবনী থেকে জানা যায়। যিনি (আবু তালেব) অনেক প্রতিকুলতার মধ্যেও রাসূল (সাঃ) কে সাহায্য করেছিলেন এবং তাঁর নবুওয়াতের ব্যাপারেও বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু মৃত্যু শয্যায় শায়িত অবস্থায় কোরাইশ নেতাদের সম্মুখে ‘কালেমা শাহাদার’ মৌখিক স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ হওয়ায় শেষ বিচারের দিনে তাকে (আবু তালেব) জাহান্নামের উত্তপ্ত জুতা পরানো হবে।


আল-কবুল বা গ্রহণ হচ্ছে প্রত্যাখ্যানের বিপরীত এবং কুরআনে গ্রহণের প্রমাণ হচ্ছে আল্লাহ্র (তায়ালা) এই কথাঃ


‘‘সত্যিই তাদেরকে যখন বলা হতঃ ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ (আল্লাহ্ ছাড়া ইবাদতের যোগ্য আর কোন ইলাহ নেই।)’’ তখন এরা অহংকারে ফেটে পড়ত। বলতঃ ‘‘আমরা এক বিকৃত মস্তিষ্ক কবির কথায় নিজেদের মাবুদদের ত্যাগ করব।’’ (আস-সাফফাতঃ ৩৫-৩৬) 


চতুর্থ শর্তঃ (আল-ইনকিয়াদ বা আত্মসমর্পণ) কুরআন ও সুন্নাহ্র নিকট পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ


আমাদেরকে অবশ্যই কুরআন ও সুন্নাহ্র কাছে পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করতে হবে। কিছু আয়াত মানা এবং বাকী আয়াত অমান্য করা যাবে না। অন্যথায় আমাদের ভাগ্যেও তাই ঘটবে যা ইয়াহুদীদের হবে। যারা এরূপ করত এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তাআলা এরশাদ করেন।


‘‘তবে কি তোমরা কিতাবের কিয়দংশ বিশ্বাস কর এবং কিয়দংশ অবিশ্বাস কর। যারা এরূপ করে, পার্থিব জীবনে দুর্গতি ছাড়া তাদের আর কোন পথ নেই। কিয়ামতের দিন তাদের কঠোরতম শাস্তির দিকে পেঁŠছে দেয়া হবে।’’(আল বাকারাহ্ঃ ৮৫)


একটি হাদীসে বর্ণিত আছে, রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ ‘‘তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মু’মিন হতে পারে না যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তার নিজের কামনাবাসনাকে আমার আনীত শিক্ষার দিকে ফিরিয়ে দেয়।’’ [সহীহ আল বুখারী]


কুরআন থেকে আত্মসমর্পণের পক্ষে প্রমাণ এই কথাঃ


‘‘ফিরে এস (অনুতপ্ত হয়ে) তোমাদের রবের দিকে এবং আত্মসমর্পণ কর তার ইচ্ছার কাছে।’’(আয-যুমারঃ ৫৪)


পঞ্চম শর্তঃ সত্যবাদীতা বা আল-সিদ্ক


সেই সত্য যা মিথ্যা বা মুনাফেকী কোনটাই অনুমোদন করে না। এই সত্যের প্রমাণ হচ্ছে আল্লাহ্ তায়ালার বাণীঃ


‘‘আলিফ লাম মীম। লোকেরা কি এই মনে করে নিয়েছে যে, ‘‘আমরা ঈমান এনেছি’’ এইটুকু বললেই তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে? আর তাদের পরীক্ষা করা হবে না? অথচ আমরা তো এদের পূর্বে অতিক্রান্ত সকল লোককেই পরীক্ষা করেছি। আল্লাহ্কে তো অবশ্যই দেখে নিতে হবে কে সত্যবাদী আর কে মিথ্যাবাদী।’’ (আন-কাবুতঃ ১,২,৩)


যে ব্যক্তি এ কলেমা শুধু মুখে উচ্চারণ করবে কিন্তু এ কলেমা দ্বারা যা বুঝানো হয় তা যদি অন্তরে অস্বীকার করে তবে সে নাজাত [মুক্তি] লাভ করতে পারবেনা, যেমনটি আল্লাহ্র বর্ণনা অনুযায়ী মুনাফিকরা লাভ করতে পারবেনা। 


‘‘আপনার কাছে মুনাফিকরা যখন আসে তখন বলেঃ আমরা স্বাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি অবশ্যই আল্লাহ্র রাসূল। আল্লাহ্ জানেন যে, আপনি অবশ্যই আল্লাহ্র রাসূল। আর আল্লাহ্ স্বাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী।’’ (মুনাফিকুনঃ ১)


আল্লাহ্ তায়ালা অন্য আয়াতে তাদেরকে মিথ্যাবাদী বলে বর্ণনা করেছেনঃ


‘‘আর মানুষের মধ্যে এমন কিছু লোক রয়েছে যারা বলে আমরা আল্লাহ্ ও পরকালের প্রতি ঈমান এনেছি, অথচ প্রকৃতপক্ষে তারা ঈমানদার নয়।’’ ( আল-বাকারাহ,ঃ ৮)


ষষ্ঠ শর্তঃ আল-ইখলাস বা অন্তরে একাগ্রতা 


নিষ্ঠাপূর্ণ ইবাদত কেবলমাত্র আল্লাহ্র জন্য। প্রতি নামাযে আমরা সূরা ফাতিহার এই কথারই স্বীকৃত দেই যে,


‘‘আমরা একমাত্র আপনারই ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।’’ [আল ফাতিহাঃ ০৪]


এই আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, আমরা শুধুমাত্র আল্লাহ্র ইবাদতই করি না সাথে সাথে তাঁর উপর পূর্ণ তাওক্কুল (ভরসা) করি। 


নিয়তের বিশুদ্ধতা (ইখলাস আল নিয়্যাহ) ইবাদত কবুলের জন্য অপরিহার্য। একটি হাদীসে আছে যে, ‘‘বিচার দিবসে তিন ব্যক্তিকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। তাদের একজন হবে আলেম, একজন দানশীল ও একজন শহীদ। তারা জাহান্নামী হবে এই কারণে যে, তাদের কর্মকান্ড আল্লাহ্কে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্য ছিল না বরং তা ছিল লোক দেখান (রিয়া)।’’ সুতরাং আমাদের ইবাদতসমূহ রিয়ামুক্ত করতে হবে কারণ রিয়াকারীর আমল বরবাদ হয়ে যাবে।


সপ্তম শর্তঃ (আল-মুহাববাত) 


আল্লাহ্র জন্যই ভালবাসা এবং আল্লাহ্র জন্যই ঘৃণা করা। (আল ওয়ালা এবং ওয়াল বারা)ঃ আমাদের যে কোন ব্যক্তি বা বস্ত্তকে আল্লাহ্র জন্য ভালবাসতে হবে এবং তাঁর জন্যই ঘৃণা করতে হবে। ইব্রাহিম (আঃ)-এর ঘটনা এর (আল ওয়ালা এবং আল বারা) উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তিনি তাঁর পিতা আযরের মিথ্যা প্রভুদের অস্বীকার করে বলেছিলেন ‘‘তোমার ও আমার বিরোধ কিয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকবে।’’ সুতরাং মু’মিনকে অবশ্যই হক (সত্য) ভালবাসতে হবে এবং বাতিল (মিথ্যা) ঘৃণা করতে হবে।


একটি হাদীসে বর্ণিত আছে যে, বিচার দিবসে সাত ব্যক্তি আল্লাহ্র আরশের ছায়া লাভ করবে, যেদিন আল্লাহ্র আরশের ছায়া ব্যতিত অন্য কোন ছায়া থাকবে না। তাদের একজন হল সেই ব্যক্তি যে আল্লাহ্র জন্য কারো সঙ্গে মিলিত হত এবং আল্লাহ্র জন্য বিচ্ছিন্ন হত।’’ [সহীহ আল বুখারী]


সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)-দের জীবনী থেকেও হকের প্রতি ভালবাসা এবং বাতিলের প্রতি ঘৃণার ভুরিভুরি উদাহরণ পাওয়া যায়। যুদ্ধের ময়দানে নিঃর্দ্বিধায় কাফের পিতা বা পুত্রকে হত্যা করে অনেক সাহাবী এর যথাযথ দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন কারণ তাঁরা কেবলমাত্র আল্লাহ্র জন্যই কাউকে ভালবাসতেন বা ঘৃণা করতেন।


‘‘মানব জাতির মধ্যে এমন কিছু লোক আছে যারা আল্লাহ্ ছাড়া অপর (শক্তি) কে আল্লাহ্র প্রতিদ্বন্দ্বী ও সমতুল্যরূপে গ্রহণ করে এবং তাকে এরূপ ভালবাসে যেরূপ ভালবাসা উচিত একমাত্র আল্লাহ্কে। অথচ প্রকৃত ঈমানদার লোকগণ আল্লাহ্কে সর্বাপেক্ষা অধিক ভালবাসে।’’ (আল-বাকারাহঃ ১৬৫)


আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, ‘‘আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ যারই নিম্নলিখিত তিনটি গুণ থাকবে সেই ঈমানের মাধূর্য লাভ করবেঃ (১) তার কাছে আল্লাহ্ ও তার রাসূল অন্য যে কোন কিছুর তুলনায় অধিক প্রিয় হবে। (২) আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে ছাড়া কোন উদ্দেশ্যে কোন ব্যক্তিকে ভাল না বাসবে।


(যখন কাউকে ভালবাসবে একমাত্র আল্লাহ্র জন্যই ভালবাসবে) (৩) অবিশ্বাসের (কুফর) দিকে প্রত্যাবর্তনকে ঘৃণা করবে, কেননা আল্লাহ্ তাকে এ থেকে রক্ষা করেছে এবং সে দোজখের আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়া ঘৃণা করে।’’ [মুসলিম]


মুসলমান হওয়ার জন্য উপরোক্ত সাতটি শর্ত প্রত্যেককে নিজের জীবনে কার্যকর করতে হবে।

লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কালেমা মুখে উচ্চারণই যথেষ্ট নয়

[যারা মনে করে যে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ মুখে বলাই তাওহীদের জন্য যথেষ্ট, বাস্তবে তার বিপরীত কিছু করলেও ক্ষতি নেই, তাদের উক্তি ও যুক্তির খন্ডন]

মুশরিকদের মনে আর একটা সংশয় বদ্ধমূল হয়ে আছে। তাহল এই যে, তারা বলে থাকে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কালেমা পাঠ করা সত্ত্বেও হযরত উসামা (রাঃ) যাকে হত্যা করেছিলেন, নবী (সাঃ) সেই হত্যাকান্ডটাকে সমর্থন করেননি।

এইরূপ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর এই হাদীসটিও তারা পেশ করে থাকে যেখানে তিনি বলেছেনঃ‘‘আমি লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আদিষ্ট হয়েছি যে পর্যন্ত না তারা বলে (মুখে উচ্চারণ করে) ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’।’’ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর উচ্চারণকারীদের হত্যা করা সম্বন্ধেও আরও অনেক হাদীস তারা তাদের মতের সমর্থনে পেশ করে থাকে।

এই মূর্খদের এসব প্রমান পেশ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, যারা মুখে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ উচ্চারণ করবে তাদেরকে কাফের বলা যাবে না এবং তারা যা ইচ্ছা তাই করুক, তাদেরকে হত্যা করাও চলবে না।

এই সব জাহেল মুশরিকদের বলে দিতে হবে যে, একথা সর্বজনবিদিত যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এবং তাদেরকে ইয়াহুদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন এবং তাদেরকে কয়েদ করেছেন যদিও তারা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলত।

আর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাহাবাগণ বানূ হানীফার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন যদিও তারা সাক্ষ্য দিয়েছিল যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর রাসূল; তারা নামাযও পড়তো এবং ইসলামেরও দাবী করত।

ঐ একই অবস্থা তাদের সম্বন্ধেও প্রযোজ্য যাদেরকে হযরত আলী (রাঃ) আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। এছাড়া ঐ সব জাহেলরা স্বীকার করে যে, যারা পুনরুত্থানকে অস্বীকার করে তারা কাফের হয়ে যায় এবং হত্যারও যোগ্য হয়ে যায়- তারা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলা সত্ত্বেও। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের যে কোন একটিকে অস্বীকার করে, সে কাফের হয়ে যায় এবং সে হত্যার যোগ্য হয় যদিও সে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলে। তা হলে ইসলামের একটি অঙ্গ অস্বীকার করার কারণে যদি তার ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর উচ্চারণ তার কোন উপকারে না আসে, তবে রাসূলগণের দ্বীনের মূল ভিত্তি যে তাওহীদ এবং যা হচ্ছে ইসলামের মুখ্য বস্তু, যে ব্যক্তি সেই তাওহীদকেই অস্বীকার করল তাকে ঐ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর উচ্চারণ কেমন করে বাঁচাতে সক্ষম হবে? কিন্তু আল্লাহর দুশমনরা হাদীস সমূহের তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করে না।

হযরত ওসামা (রাঃ) হাদীসের তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, তিনি একজন ইসলামের দাবীদারকে হত্যা করেছিলেন এই ধারণায় যে, সে তার জান ও মালের ভয়েই ইসলামের দাবী জানিয়েছিল।

কোন মানুষ যখন ইসলামের দাবী করবে তার থেকে ইসলাম বিরোধী কোন কাজ প্রকাশ্যে অনুষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত সে তার জানমালের নিরাপত্তা লাভ করবে। এ সম্বন্ধে কুরআনের ঘোষণা এই যে,
‘‘হে মু’মিন সমাজ! যখন তোমরা আল্লাহর রাহে বহির্গত হও, তখন (কাহাকেও হত্যা করার পূর্বে) সব বিষয় তদন্ত করে দেখিও।’’ (সূরা নিসা ৪ঃ ৯৪)
অর্থাৎ তার সম্বন্ধে তথ্যাদি নিয়ে দৃঢ় ভাবে সুনিশ্চিত হইও। এই আয়াত পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, এরূপ ব্যাপারে হত্যা থেকে বিরত থেকে তদন্তের পর স্থির নিশ্চিত হওয়া অবশ্য কর্তব্য। তদন্তের পর যদি তার ইসলাম বিরোধিতা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় তবে তাকে হত্যা করা যাবে। যেমন আল্লাহ বলেছেন, (ফাতাবাইয়ানূ) অর্থাৎ তদন্ত করে দেখ। তদন্ত করার পর দোষী সাব্যস্ত হলে হত্যা করতে হবে। যদি এই অবস্থাতে হত্যা না করা হয় তা হলেঃ ‘ফাতাবাইয়ানু’- তাসাববুত (অর্থ) অর্থাৎ স্থির নিশ্চিত হওয়ার কোন অর্থ হয়না।

এইভাবে অনুরূপ হাদীসগুলোর অর্থ বুঝে নিতে হবে। ঐগুলোর অর্থ হবে যা আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি। অর্থাৎ যে ব্যক্তির মধ্যে তাওহীদ ও ইসলাম প্রকাশ্যভাবে পাওয়া যাবে তাকে হত্যা করা থেকে বিরত থাকতে হবে- যে পর্যন্ত বিপরীত কোন কিছু প্রকাশিত না হবে। এ কথার দলীল হচ্ছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কৈফিয়তের ভাষায় ওসামা (রাঃ)-কে বলেছিলেনঃ ‘‘তুমি হত্যা করেছ ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলার পরও ?
এবং তিনি আরও বলেছিলেনঃ ‘আমি লোকদেরকে হত্যা করতে আদিষ্ট হয়েছি যে পর্যন্ত না তারা বলবেঃ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। সেই রাসূলই কিন্তু খারেজীদের সম্বন্ধে বলেছেনঃ

অর্থাৎ ‘‘যেখানেই তোমরা তাদের পাবে, হত্যা করবে, আমি যদি তাদের পেয়ে যাই তবে তাদেরকে হত্যা করব ‘আদ জাতির মত সার্বিক হত্যা।’’ (বুখারী ও মুসলিম) যদিও তারা ছিল লোকদের মধ্যে অধিক ইবাদতগুযার, অধিক মাত্রায় ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এবং সুবাহানাল্লাহ উচ্চারণকারী।

খারেজীরা এমন বিনয়-নম্রতার সঙ্গে নামায আদায় করত যে, সাহাবাগণ পর্যন্ত নিজেদের নামাযকে তাদের নামাযের তুলানায় তুচ্ছ মনে করতেন। তারা কিন্তু ইলম শিক্ষা করেছিল সাহাবাগণের নিকট হতেই। কিন্তু কোনই উপকারে আসল না তাদের ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা, তাদের অধিক পরিমাণ ইবাদত করা এবং তাদের ইসলামের দাবী করা, যখন তাদের থেকে শরী’আতের বিরোধী বিষয় প্রকাশিত হয়ে গেলে।

ঐ একই পর্যায়ের বিষয় হচ্ছে ইয়াহুদদের হত্যা এবং বানু হানীফার বিরুদ্ধে সাহাবাদের যুদ্ধ ও হত্যাকান্ড। ঐ একই কারণে নবী (সাঃ) বানী মুস্তালিক গোত্রের বিরুদ্ধে জিহাদ করার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন যখন তাঁকে একজন লোক এসে খবর দিল যে, তারা যাকাত দিবেনা। এই সংবাদ এবং অনুরূপ অবস্থায় তদন্তের পর স্থির নিশ্চিত হওয়ার জন্য আল্লাহ আয়াত নাযিল করলেনঃ
‘‘হে মুমিন সমাজ! যখন কোন ফাসেক ব্যক্তি কোন গুরুতর সংবাদ নিয়ে তোমাদের নিকট আগমন করে, তখন তোমরা তার সত্যতা পরীক্ষা করে দেখবে।’’ (সূরা হুজরাত ৪৯ঃ ৬)

জেনে রাখ, উপরোক্ত সংবাদদাতা তাদের সম্বন্ধে মিথ্যা সংবাদ দিয়েছিল। 
এইরূপে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর যে সমস্ত হাদীসকে তারা হুজ্জত রূপে পেশ করে থাকে তার প্রত্যেকটির তাৎপর্য্য তাই যা আমরা উল্লেখ করেছি। 

জিহাদ কখন ফারয হয়


জিহাদ কখন ফারদুল ‘আইন হয়?

তিনটি পরিস্থিতিতে জিহাদ ফারদুল আইন হয়ঃ

১. যুদ্ধে যখন ২টি বাহিনী মুখোমুখি হয় এবং তারা অগ্রসর হতে থাকে।

২. যদি কুফফার কোন জমীনে প্রবেশ করে, তবে ঐ জমীনের অধিবাসীদের উপর জিহাদ ফারয।

৩. যদি ইমাম কোন কওমকে এগিয়ে যেতে বলে, তাহলে ঐ কওমের জন্য জিহাদ ফারদুল আইন।

মু’মিনদের গুণাবলী


আল-শাতিবি (রহিমাহুল্লাহ)কুরআনসুন্নাহরআলোকেএকজনমুসলমানেরভালগুনাবলীখারাপবৈশিষ্ট্যগুলোরতালিকাতৈরিকরেছেনএগুলোবান্দাকেনফলইবাদাতবেশীকরারমাধ্যমেতাররবেরনিকটবর্তীকরতেতাদেরনফসকেউন্নতবিশুদ্ধকরতেসাহায্যকরবে


ভালগুনাবলীঃ


ন্যায়বিচার,


দয়া


ওয়াদাপূরণকরা,


সহনশীলতাক্ষমাপ্রদর্শনকরা,


মূর্খদেরএড়িয়েচলা,


সবর,


শুকরগুজার,


আত্নীয়মিসকিনঅভাবীদেরসাহায্যকরা,


খরচেরক্ষেত্রেমধ্যমপন্থাঅবলম্বনকরা,


১০. সৎ কাজের আহবানে সাড়া দেয়া,


১১আল্লাহকে ভয়করা(খওফ),


১২আশারাখা (আল্লাহরকাছে),


১৩আল্লাহকেসম্মানকরা,


১৪ওজনকরারসময় (আল্লাহকে) ভয়করা,


১৫সঠিকপথঅনুসরনকরা,


১৬আল্লাহকেস্মরণকরা (যিকর),


১৭ন্যায়পরায়ণতা,


১৮আল্লাহরডাকেসাড়াদেয়া


১৯. আল্লাহকে ভয় করা (খশীয়া’)


২০ঈমানদারদেরসামনেবিনয়ীথাকা,


২১আল্লাহরসন্তুষ্টিরজন্যদাওয়াহদেয়া,


২২ঈমানদারদেরজন্যদোকরা,


২৩একনিষ্টতা,


২৪আল্লাহরসন্তুষ্টিরজন্যসকলকাজকরা,


২৫গীবতথেকেদূরেথাকা,


২৬বিশ্বাসবজায়রাখা,


২৭রাতেরবেলাইবাদাতকরা(কিয়াম-উল-লাইল)


২৮আল্লাহরকাছেদোকান্নাকাটিকরা,


২৯আল্লাহরপ্রতিবিশ্বাসরাখা,


৩০দুনিয়ারপ্রতিবেশীমনোযোগনাদেয়া,


৩১আখিরাতেরব্যাপারেকথাবলা,


৩২আল্লাহমুখীহওয়া,


৩৩সৎকাজেরআদেশদেয়া,


৩৪অসৎকাজেনিষেধকরা,


৩৫তাকওয়া (আল্লাহভীতি)


৩৬মানবতাবোধ,


৩৭আল্লাহরপ্রতিমুখাপেক্ষীথাকা,


৩৮অন্তরকেপবিত্ররাখা,


৩৯. সততার সাথে শাসন করা,


৪০. ভাল কাজে সহায়তা করা,


৪১তাওবা,


৪২. সব কাজে আল্লাহকে ভয় করা,


৪৩. স্বাক্ষ্য দেয়া,


৪৪. জাহেলদের বর্জন করা,


৪৫শাইত্বানথেকেআল্লাহরকাছেসাহায্যচাওয়া,


৪৬. আল্লাহর প্রশংসা করা,


৪৭অন্যকেসতর্ককরা,


৪৮. আল্লাহর রহমতের কথা সবাইকে বলা,


৪৯কুরআনতিলাওয়াতকরা,


৫০. সৎ কাজে সাহায্য করা,


৫১আল্লাহরআযাবকেভয়করা


৫২পুরস্কারেরআশারাখা


৫৩. সব সময় একনিষ্ট থাকা,


৫৪আল্লাহসবদেখছেনএটিস্মরণরাখা,


৫৫সত্যকথাবলা,


৫৬. সৎ কাজে প্রতিযোগীতা করা,


৫৭. রাগ দমন করা,


৫৮. আত্নীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা,


৫৯. মীমাংসার ক্ষেত্রে আল্লাহ ও তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিচারক মানা,


৬০. আল্লাহর আদেশের কাছে আত্নসমর্পন করা,


৬১. নফল রোজা রাখা,


৬২. নীরব থাকা,


৬৩. আল্লাহর ওপর ভরসা করা,


৬৪. দুইজন মানুষের মধ্যে সম্পর্ক ভাল করা,


৬৫. আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মানুষকে ভালবাসা,


৬৬. কুফফারদের প্রতি কঠোরতা দেখানো,


৬৭. ঈমানদারদের প্রতি দয়া দেখানো।